আজকাল কেউ যদি কোনো বিজ্ঞান-সংক্রান্ত পত্র-পত্রিকায় খবর পড়তে যান তাহলে আর কিছু না হোক একটা বিষয়ে খবর প্রথম পাতায় পাবেনই। সেটা হলো জেনেটিক্স। মানে জিনতত্ত্ব। বিজ্ঞানের খবর পড়লেই দেখবেন হয় কোনো বিজ্ঞানী নতুন কোনো রোগের জন্য দায়ী কোনো জিন আবিষ্কার করেছেন, না হয় আর কেউ কোনো প্রাণীকে ক্লোন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তা না হলে উচ্চফলনশীল ধানের চাষ হচ্ছে_ সবই কোনো না কোনোভাবে জিনতত্ত্বের সঙ্গে জড়িত।

জেনেটিক্সের তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুরু হয়ে থাকলেও বংশগত বলে কিছু যে হয় তা আদিম যুগ থেকেই মানুষ পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান হিসেবে কাজে লাগিয়ে এসেছে। একজন মানুষের নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে আচার-আচরণগত মিল তখনো লক্ষ্য করা হতো। বাবা-মায়েরা নিজের ছেলেমেয়ের মধ্যে নিজেদের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বেড়াতেন তখনো। তবে তার প্রয়োগ ছিল মূলত পশুপালন আর কৃষিকাজে। তখন তত্ত্বগতভাবে এতটা শক্তিশালী না হলেও পর্যবেক্ষণ করে অনেক দূর এগিয়েছিল মানবসভ্যতা।

কিন্তু কি কারণে এই বংশগত লক্ষ্য করা যায়? কি সেই বস্তু যা জীবের শরীর থেকে বার্তা বয়ে নিয়ে যায় অপত্যের শরীরে? বাবা-মায়ের মতো গুণ কেন ছেলেমেয়ে পায়? তা নিয়ে নিশ্চয় জল্পনা আদিম যুগেও ছিল। তবে এই ধারণাকে প্রথম তত্ত্বের আকার দেওয়ার চেষ্টা করে গ্রিকরা। হিপোক্রিটাস এক তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন যার নাম প্যাঞ্জেনেসিস। তার দাবি ছিল যৌন মিলনের সময় শরীরের বিভিন্ন অংশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ কোনো না কোনোভাবে বংশগতি বয়ে নিয়ে যায়। এই তত্ত্ব আজকে আমাদের কাছে যতই হাস্যকর লাগুক, আজ থেকে দু'হাজার বছর আগে এটাই ছিল অনেক সত্য। এই তত্ত্ব অনেক দিন পরে হাতে গিয়ে পড়ে চার্লস ডারউইনের। 'অরিজিন অব স্পিসিস'-এর পরই ডারউইন তখন সবে আলোচনার মূলে এসেছেন। তার অরিজিন অব স্পিসিসে তিনি আগেই দাবি জানিয়েছিলেন বংশগতির সঙ্গে প্রকরণ-এর সম্পর্কের কথা। সেই বংশগতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি তখন আবার ফিরিয়ে আনলেন এই প্যানজেনেসিসকে। মেন্ডেলের দাবি মতে, সারা শরীরের কোষগুলো থেকে গেমুলস বলে এক ধরনের পদার্থ ক্ষরিত হয়_ যা কিনা জমা হয়ে থাকে মানুষের যৌনাঙ্গে। এভাবেই সব কোষই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য অপত্যে পেঁৗছে দেওয়ার একটা সুযোগ পায়। এ দিয়ে তিনি অনেকগুলো পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যাও দিয়ে দিলেন। অনেক সময়েই দাদুর বৈশিষ্ট্য নাতি পেয়ে যায়, কিন্তু ছেলে পায় না। সেটা কেন হয়? না অনেক গেমুলস সুপ্ত হয়ে যায় জননের সময় কিন্তু পরবর্তীতে আবার জেগে উঠতে পারে। তারাই এর জন্য দায়ী। এই তত্ত্ব তিনি পেশ করলেন ১৮৬৮ সালে, তার বই 'ভ্যারিয়েশন অব এনিম্যালস এন্ড প্লান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন' নামক বইতে। এর পরের বই 'দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান'-এ তিনি মানুষের মধ্যে এর প্রভাব নিয়েও বিশদ আলোচনা করেন এই একই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই। এই বইতে তিনি আরো বলেন, যে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আবার লিঙ্গভেদে সুপ্ত হয়ে যায়, তাই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে একই গেমুলস থেকে হলেও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য আলাদা ধরনের হয়। সব থেকে মজার কথা, ডারউইন এটাও বলেন, জীবিত সময়ে অর্জিত বৈশিষ্ট্যও পরবর্তী প্রজন্মে পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব_ যেটা ছিল আদপে ল্যামার্কের মতবাদ। যদিও বিবর্তনের জন্য এই অধিগত বৈশিষ্ট্যকে তিনি স্বীকার না করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতি উদ্ভাবন করেছিলেন। গেমুলাস দিয়ে বংশগতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি সেই ল্যামার্কের ভুলটাই ফিরিয়ে আনলেন।

প্যানজেনেসিসের মতে, অনেক তত্ত্বে মনে করা হতো মাতৃজঠরে ভ্রূণ কিছু অতিক্ষুদ্র অংশ নিয়ে তৈরি হয়। এই তত্ত্বের নাম প্রিফর্মেশনিজম। এই অতিক্ষুদ্র অংশগুলো এক একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে। সহজ কথায়, যেভাবে ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি হয়, সেভাবেই আরো কিছু ক্ষুদ্র হোমানকুলাই থেকে ভ্রূণ তৈরি হয়। হোমানকুলাই আবার যে কোনো লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে, কারণ উভয়ের উপস্থিতিতেই তা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই তত্ত্বও ধোপে বেশিদিন টেকেনি। মাইক্রোস্কোপের বহুল ব্যবহার শুরু হওয়ার পর অনেক খুঁজেও এরকম কোনো হোমানকুলাই পাওয়া যায়নি। দু'একটা নড়াচড়া করা ছাড়া ছোটখাটো কিছুই না। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্বের চেয়ে এটা বেশিদিন চলেছিল। হয়ত তত্ত্বটা ডারউইনের ছিল বলে, অথবা ছোট গেমুলাসগুলো এতটাই 'ছোট' ভাবা হচ্ছিল যে, মাইক্রোস্কোপকেও বিজ্ঞানীরা ততটা ভরসা করতে পারছিলেন না। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিলেন অগাস্ট ওয়েইম্মান নামে আরেক বিজ্ঞানী। তিনি একটি ইঁদুরের লেজ কেটে দেখালেন যে, লেজকাটা ইঁদুরের বাচ্চার লেজ তো গোটাই থাকে। কিন্তু গেমুলাস তাহলে মনে করে, সেই বৈশিষ্ট্য পরের প্রজন্মে প্রবাহিত করে না। তিনি বংশগতির ধারকের নাম দিলেন জার্মপ্লাজম। আর বললেন, কোনো জীবের জীবদ্দশায় কোনো অধিগত বৈশিষ্ট্য জার্মপ্লাজমকে প্রভাবিত করে না।

বংশগতি নিয়ে হয়তো ডারউইনের মাথা ঘামানোরই দরকার হতো না যদি তার সমসাময়িক আরেক বিজ্ঞানীর কাজ তার হাতে এসে যেত। অবশ্য বিজ্ঞানী নন, পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন ধর্মযাজক। তিনি হলেন গ্রেগর যোহান মেন্ডেল জিন-বিজ্ঞানের পিতৃপুরুষ। মনাস্ট্রিতে তিনি মটর গাছের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লক্ষ্য করেন। তিনি ধারণা করলেন বংশগতি কোনো বাহকের মাধ্যমে অপত্যের মধ্যে আসে এবং এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকে, অথচ অপত্য পিতা-মাতা উভয়ের কাছ থেকেই অপত্য একটি করে বাহক পেয়ে থাকে_ পরবর্তীকালে এরই নাম দেওয়া হয় জিন। যেমন ধরা যাক যে, মটর দু'রকম রঙের হয়_হলুদ আর সবুজ। তার ব্যাখ্যায় সবুজ মটরে উভয়ের থেকেই সবুজ ()ে হওয়ার জিন পেয়েছে তাই ওটি সবুজ আর হলুদ মটরে অন্তত একটি জিন হলুদ (ু) হওয়ার জিন। শুধু ে েহলো সবুজ, আর বাদবাকি ণণ, ণ েআর ণে হলো হলুদ। কারণ_ হলুদ হলো প্রকট বৈশিষ্ট্য আর সবুজ হলো সুপ্ত। এই ব্যাখ্যা সরাসরি বংশগতির অনেকগুলো সমস্যাকে সমাধান করে দিল। দাদুর রোগ নাতির মধ্যে দেখা যায়, অথচ ছেলের মধ্যে দেখা যায় না_ কারণ ছেলের মধ্যে বৈশিষ্ট্য সুপ্ত থাকে_ যে জিন এর জন্য দায়ী সেটা সুপ্ত বৈশিষ্ট্য। পরাগরেণু বা বাহকের মধ্যে থাকে একটি মাত্র জিন। পদার্থবিদের মতে, সংখ্যাগুণে তিনি দেখালেন এই ভাঙা-জোড়ার পদ্ধতি পুরো র‌্যান্ডম_ ণ ে গাছের পরাগরেণুর মধ্যে অর্ধেক ণ আর বাকি অর্ধেক ে থাকবেই। আর তৈরি গাছে ২৫% বা এক-চতুর্থাংশের রং হবে সবুজ।

১৯০২ সালে আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র ওয়াল্টার সাটন ফড়িংয়ের ক্রোমোজোম অণুবীক্ষণের তলায় দেখতে গিয়ে দেখেন ক্রোমোজোমও আসলে একজোড়া_ ঠিক যেমন মেন্ডেল বর্ণিত বাহকের হওয়ার কথা। কিন্তু ঠিক একটা জায়গায় ব্যতিক্রম_ যৌন কোষে। এটাও মেন্ডেলের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। মেন্ডেল বর্ণিত অপত্যের মধ্যে পিতা-মাতার কাছ থেকে এটাই বাহক আসে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মেন্ডেল বর্ণিত বাহক ক্রোমোজমের মধ্যেই আছে। তার লেখা পেপার প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে। পরে জার্মান বিজ্ঞানী বোভেরিও একই সিদ্ধান্তে পেঁৗছান। তাই এই মতবাদটি সাটন-বোভেরি মতবাদ বলে পরিচিত ছিল।

রনক ইকরাম

0 comments

Post a Comment