সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে নিপাহ ভাইরাস নামের একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াছে। সামান্য অসকর্ততার কারণে এ রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ কারণে নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে জানা ও আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
নিপাহ ভাইরাস কী?
নিপাহ ভাইরাস একটি ইমার্জিং জেনেটিক ভাইরাস যেটি জন্তু থেকে মানুষে ছড়ায়। ভাইরাসটি মস্তিষ্ক বা শ্বসনতন্ত্রে প্রদাহ তৈরির মাধ্যমে মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করে।
প্রাদুর্ভাব
মানুষের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায়। এরপর ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে। দুই দেশে তখন ২৭৬ জন মারা যায়। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের পর ভারত ও বাংলাদেশ এর অস্তিত্ব খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথম নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। লালমনিরহাটে শনাক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ২০০১ সাল থেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫২ জন। এর মধ্যে ১১৩ জনই মারা গেছেন। এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাস দ্বারা ১৬টি মহামারীর ঘটনা ঘটে, যার বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ায়।
নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগ
নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণে মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ হয়। এই রোগটি হার্পিস ভাইরাস ও ফ্লাভিভাইরাসসহ অন্যান্য ভাইরাস দ্বারাও হতে পারে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে এনসেফালাইটিস নামক যে রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তার কারণ নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ।
যেভাবে ছড়ায়
শূকরের মাধ্যমে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এ ভাইরাসটি প্রথম ছড়িয়ে পড়েছিল। আক্রান্ত শূকরের সংস্পর্শ, তাদের লালা ও সংক্রমিত মাংসের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও ভারতে বাদুরের মাধ্যমে এ ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করে। মূলত শীতকালে এর সংক্রমণ বাড়তে থাকে। শীতকালে খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। এ সময় রসের পাতিলটি খোলা থাকায় সেখানে বাদুড়ের লালা, প্রশ্রাব এমনকি বাদুড়ের দেহ থেকে নিঃসৃত সব তরল পদার্থ থেকে এই ভাইরাস রসের সাথে যুক্ত হতে পারে। পরবর্তীতে রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে কাঁচা পেয়ারা, বরই বা অন্য ফল থেকে সংক্রমণ হতে পারে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
যেহেতু এই ভাইরাসের জন্য কোনো প্রতিষেধক টিকা নেই, তাই সচেতনতাই পারে এ রোগের প্রাদুর্ভাবকে কমাতে।
০০ পাখি দ্বারা আধা খাওয়া ফল ও কাঁচা খেজুরের রস না পান করা।
০০ আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। তাই যারা রোগীদের সেবা দিয়েছেন এবং মৃতদের সৎকার করেছেন, তাদের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
০০ আক্রান্তদের পরিচর্যা করতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীর ব্যবহূত কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার না করে আবার ব্যবহার করা যাবে না।
০০ রোগীর পরিচর্যা করার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণূমুক্ত করতে হবে।
০০ রোগীর কফ ও থুতু যেখানে সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
০০ রোগীর সঙ্গে একই পাত্রে খাওয়া বা একই বিছানায় ঘুমানো যাবে না।
০০ রোগীর শুশ্রুষা করার সময় মুখে কাপড়ের মাস্ক পরে নিতে হবে।
০০ সর্বোপরি যে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হওয়ার পর আরো অন্তত ২১ দিন পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।
নিপাহ ভাইরাস মারাত্মক ভাইরাস বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা ভাইরাসের মতো এটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে না। কেবলমাত্র সতর্কতাই এ ভাইরাস থেকে বাঁচার প্রধান উপায়।
0 comments