বিসমিল্লাহ্‌ বলে জীবনের প্রথম ডিএসএলআর কেনার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেললেন তখন নেক্সট যে চিন্তা মাথায় আসে তা হল ক্যামেরার সাথে কোন লেন্স টা কিনবেন? ডিএসএলআর-এর সাথে ফ্রী আসা কিট লেন্স এই কি চলবে? নাকি আরও টাকা খরচ করে অন্য কোন লেন্স কিনে ফেলবেন? আর কিনলেও কোনটা, কোন ধরনের লেন্স কিনবেন; টেলিফটো নাকি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, ফাস্ট নাকি স্লো, প্রাইম নাকি জুম? এরকম হাজারটা প্রশ্ন আসবে মাথায়। তখন বেশীরভাগ মানুষ যা করে তা হল একটি জুম লেন্স কিনে ফেলে কিছু না বুঝেই! তাদের জন্যই এই গাইড, যারা কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কোন লেন্স টা কিনবেন।

লেন্স এর রকমফের.................

জুম লেন্সঃ

এটা হল এমন একটি লেন্স যেটা দিয়ে আপনি একটি রেঞ্জ এর ভেতর ফোকাল লেংথ পরিবর্তন করতে পারবেন। যেমন, বাজারে নিকনের সবচেয়ে কমন কিট লেন্স হল Nikon 18-55mm f/3.5-5.6। অর্থাৎ এটা দিয়ে আপনি ফোকাল লেংথ সর্বনিম্ন ১৮মিমি আর সর্বোচ্চ ৫৫মিমি করতে পারবেন। এখন প্রশ্ন হল ১৮মিমি তে ছবি তুললে কেমন দেখাবে? তখন এটা হবে অনেকটা ওয়াইড আঙ্গেল লেন্স এর মত। আর ৫৫মিমি তে ছবি তুললে সেটা হবে টেলিফটো।

জুম লেন্স ব্যাবহারের উপকারিতা হল এটা দিয়ে আপনি কম্পোজিশন অথবা পার্সপেক্টিভ অনেক সহজেই চেঞ্জ করতে পারবেন। ধরুন কোন বাচ্চার ছবি তুলতে চান, কিন্তু সে খেলছে। জুম লেন্স থাকলে আপনি দূর থেকে জুম করেই কাঙ্ক্ষিত ছবিটি পেতে পারেন। আর সাংবাদিকদের জন্য তো জুম লেন্স ই একমাত্র ভরসা। সাধারণত পয়েন্ট অ্যান্ড শুট কামেরাগুলোয় জুম লেন্স থাকে, তাই আমরা সবাই কমবেশি জুম ব্যবহার সম্পর্কে জানি যে এটা দিয়ে দুরের জিনিশ বড় করা যায়। এখন যে জিনিশটা নতুন জানলাম তা হল টেকনিক্যাল সংজ্ঞাঃ জুম হল এমন একটি লেন্স যেটার ফোকাল লেংথ পরিবর্তন করা যায়।

প্রাইম লেন্সঃ

এখন আসি প্রাইম লেন্স এ। প্রাইম লেন্স হল জুম এর বিপরীত, অর্থাৎ এটার ফোকাল লেংথ ফিক্সড, চেঞ্জ করা যাবে না। বুঝতেই পারছেন সহজ বাংলায় এটায় আপনি দুরের জিনিস বড় করতে পারবেন না। কিন্তু মানুষ তবুও কেন প্রাইম লেন্স ইউজ করছে যেখানে জুম এর এত সুবিধা? কারন হল প্রাইম লেন্স এর দাম, ওজন এবং স্পীড। একটি কমদামী প্রাইম লেন্স সাধারণত একটি হাই-এন্ড জুম লেন্স এর সমমানের অথবা তার চেয়েও বেশি ভাল ইমেজ কোয়ালিটি দিতে সক্ষম! এছাড়াও প্রাইম লেন্সে সাধারণত বড় অ্যাপারচার থাকে জুম এর চেয়ে। অ্যাপারচার বড় হবার সুবিধা হল লেন্স এ বেশি লাইট ঢুকবে এবং কম আলতেও আপনি উজ্জ্বল ছবি পাবেন, এবং শ্যালো ডেপ্তহ অফ ফীল্ড তো পাবেনই বোকেহর জন্য। আর জুম লেন্স সাধারণত হয় বড় সাইজের আর ভারী, যেখানে প্রাইম লেন্স হয় অনেক হাল্কা আর আকারেও ছোট। তাই আপনার ডিএসএলআর এ প্রাইম লেন্স লাগিয়ে নিলে আর হাত ব্যাথা হবে না।

কিন্তু এতকিছু সম্ভব কিভাবে? কারণটা সহজ, জুম লেন্স এ যেহেতু ফোকাল লেংথ বড় করার একটা ব্যাপার থাকে ওটার ভেতর নানান কলকব্জা থাকে যা নড়াচড়া করে আপনার কাঙ্ক্ষিত ফোকাল লেংথ অর্জন করে। কিন্তু প্রাইম লেন্স এ এই ঝামেলা নেই এবং তাই জাস্ট একটা ফিক্সড লেন্স থাকে এটার ভেতর। আর তাই তো প্রাইম লেন্স এর দাম কম, ওজন কম, আকারেও ছোট কিন্তু কোয়ালিটি অনেক ভাল।

কিন্তু লেন্স এর নাম দেখে কিভাবে বুঝবেন কোনটি প্রাইম আর কোনটি জুম লেন্স? নিকন এর বহুল জনপ্রিয় একটি লেন্স হল Nikon 50mm f/1.8। এটা হল একটি প্রাইম লেন্স। লক্ষ্য করুন, জুম লেন্সটার নাম ছিল Nikon 18-55mm f/3.5-5.6। জুম টার নামেই আছে ১৮-৫৫মিমি আর এটায় শুধু ৫০মিমি লেখা। অর্থাৎ এটার ফোকাল লেংথ ফিক্সড।

ছবির উপর ফোকাল লেংথ এর প্রভাব

উপরের ছবিটি লক্ষ্য করুন। ধরুন আপনার একটি ২৮-২০০মিমি জুম লেন্স আছে। যদি ২৮মিমি তে ছবি তোলেন তাহলে পুরো দৃশ্যটাই ধরা দেবে ফ্রেমে। ২৮মিমি হল শর্ট ফোকাল লেংথ রেঞ্জ এ। অ্যাপ্রক্সিমেটলি ৩০মিমির নিচের ফোকাল লেংথ কে আমরা বলি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স।

যদি আর একটু জুম করেন, অর্থাৎ ২৮মিমি থেকে ৫০মিমি তে যান তাহলে ছবির এক অংশ বাদ যাবে, কার্যত আপনি দুরের জিনিসগুলো বড় করলেন।

এভাবে ফোকাল লেংথ বাড়াতে বাড়াতে যদি ২০০মিমি তে যান তাহলে ফ্রেমে শুধু দুরের বাড়িটাই দেখা যাবে, অর্থাৎ আপনি দুরের ছোট ছোট বারি গুলোই জুম করে বড় করলেন এক্ষেত্রে। ৫০মিমির উপরের ফোকাল লেংথ হলে তখন আমরা এটাকে বলি টেলিফটো লেন্স।

এবার চিন্তা করুন, আপনার যদি একটি ৫০মিমি প্রাইম লেন্স থাকে তাহলে ওটা দিয়ে তাকালেই আপনি ৫০মিমি এর বক্স টার ভিউ পাবেন। জুম ইন, জুম আউট কিছুই করতে পারবেন না।

আবার যদি একটা ২০০মিমি প্রাইম থাকে তাহলে আপনি ওটা দিয়ে তাকালে শুধু ২০০মিমি এর বক্স এর ভেতর যেটুকু আছে ওটাই দেখবেন। অর্থাৎ তখন আপনি সবকিছু বড় আকারে দেখবেন, কিন্তু কাছের কিছুর ছবি তুলতে পারবেন না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ফটোগ্রাফাররা বন্য প্রানিদের ছবি কিন্তু এরকম লং ফোকাল লেংথ এর প্রাইম দিয়ে তোলে, জুম দিয়ে না! এগুলোকে টেলিফটো লেন্সও বলা হয়।

ওয়াইড আঙ্গেল লেন্স হল শর্ট ফোকাল লেংথ ওয়ালা লেন্স গুলো। যেমন ধরুন Nikon 10-24mm f/3.5-4.5। এটা কে কি লেন্স বলবেন? এটা যেহেতু ১০-২০মিমি অর্থাৎ ফোকাল লেংথ চেঞ্জ হয় তাই এটা একটি জুম লেন্স। তবে লক্ষ্য করুন এটার ফোকাল লেংথ কিন্তু খুবি শর্ট। ১০মিমি থেকে ২০মিমি মাত্র। অর্থাৎ এটার ফোকাল লেংথ এর রেঞ্জ কিন্তু ওয়াইড অ্যাঙ্গেল এর ভেতর পরে। তাই এটাকে বলব ওয়াইড অ্যাঙ্গেল জুম লেন্স।

লেন্স স্টেবিলাইজেসন

জুম লেন্স এর আসল সমস্যা হল জুম করলে আপনার হাতের হালকা কাঁপুনিও ছবিতে বড় ধরনের ব্লার ঘটাতে পারে। আর তাই আজকালকার জুম লেন্স গুলোয় অটো স্টেবিলাইজেসন অপশন থাকে। Nikon এর ক্যামেরায় একে বলে VR(Vibration Reduction)। আর Canon এর ক্যামেরায় একে বলে IS(Image Stabilization)। নাম ভিন্ন হলেও, জিনিস একই। লেন্স এর ভেতরকার কলকব্জা নেড়েচেড়ে এটা আপনার হাতের কারনে যেটুকু শেক হয় ওটা কম্পেন্সেট করে। সোজা কথায় VR অথবা IS অন করে নিলে আপনার হাত নড়লেও শার্প ছবি পাওয়ার চান্স অনেকগুনে বেরে যাবে।

স্পীড (না, শুধু জলিল এর নয়, লেন্স এরও স্পীড আছে tongue emoticon )

লেন্স এর স্পীড থাকে কিভাবে? ধরুন আপনার লেন্স এর অ্যাপারচার যদি ছোট হয় তাহলে বেশি আলো ঢুকতে পারবে না। অর্থাৎ, একটি সঠিকভাবে আলোকিত ছবি পেতে আপনার বেশিক্ষণ সাটার খুলে রাখতে হবে। আর অ্যাপারচার যদি বড় হয় তাহলে বুঝতেই পারছেন অনেক দ্রুত কম আলোতেও ছবি তুলতে পারবেন। এখন কথা হল ফাস্ট লেন্স কোনটা বুঝবেন কিভাবে? বুঝবেন, লেন্স এর fstop নাম্বার দেখে। আগের দুটো লেন্স দিয়েই উদাহরন দেই। একটি লেন্স হল Nikon 18-55mm f/3.5-5.6 আরেকটি হল Nikon 50mm f/1.8। এখানে ১৮-৫৫মিমি লেন্স টার ওয়াইডেস্ট অ্যাপারচার হল f/3.5 আর ৫০মিমি লেন্স টার হল f/1.8। অর্থাৎ ৫০মিমি টায় অন্যটার চেয়ে বড় অ্যাপারচার হয়, অর্থাৎ বেশি লাইট ঢুকবে এবং তাই এটা ফাস্টার। তাই এক্সপোজার টাইম ও কম লাগবে এটায়।

ইভেন্ট ফটোগ্রাফাররা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খুব কম আলোয় কাজ করে আর তাই তাদের পছন্দ হল খুব ফাস্ট লেন্স। কারন অনুষ্ঠানে মানুষজন সবসময় চলতে ফিরতে থাকে, আর তাদের মুভমেন্ট এর কারনে যাতে ছবি ব্লারড না আসে তাই সাটার স্পীড ১ সেকেন্ড এর ৫০ ভাগের মত দিতে হয়। আপনার লেন্স যদি ম্যাক্সিমাম অ্যাপারচার হয় f/3.5 তাহলে ছবি আসবে অন্ধকার কারন পর্যাপ্ত আলো ঢুকতে পারবে না লেন্স এ এত অল্প সময়ে। কিন্তু f/1.8 এ আবার এই অল্প সময়েই একটি উজ্জ্বল ছবি পাবেন।

আরেকটি কথা, খেয়াল করুন Nikon 18-55mm f/3.5-5.6 লেন্স এ ফোকাল লেংথ এর পাশাপাশি অ্যাপারচারও কিন্তু একটা রেঞ্জ হিসেবে দেওয়া। অর্থাৎ জুম করলে ম্যাক্সিমাম অ্যাপারচার ছোট হবে। ১৮মিমি তে ম্যাক্স অ্যাপারচার পাবেন f/3.5 আর ৫৫মিমি তে পাবেন আর ছোট f/5.6। তাই খেয়াল করে দেখবেন, আপনার পয়েন্ট অ্যান্ড শুট এও জুম করে ছবি তুলতে গেলে ছবি একটু অন্ধকার হয়ে যায়।

তবে কিছু জুম লেন্স আছে যেগুলোয় আবার জুম করলেও ম্যাক্স অ্যাপারচার চেঞ্জ হয়না। যেমন Nikon Nikkor AF-S 12-24mm f/4। এটার ম্যাক্সিমাম অ্যাপারচার f/4 আপনি ১২মিমি তেও পাবেন আবার ২৪মিমি তেও পাবেন। তবে স্বভাবতই এগুলর দাম আকাশচুম্বী। থার্ড পার্টি লেন্স আছে ফিক্সড অ্যাপারচার এর যেমন Tamron SP AF 17-50mm F/2.8। এটায় আপনি ১৭মিমি থেকে ৫০মিমি ফোকাল লেংথ এ ছবি তুলতে পারবেন F/2.8 এই!
-
অসহায় নাগরিক

0 comments

Post a Comment