এসএমএস কী?
এসএমএস কথাটির পূর্ণরূপ হচ্ছে শর্ট ম্যাসেজ সার্ভিস বা
শর্ট ম্যাসেজিং সার্ভিস (short message/messaging service)। বাংলায় একে বলা
যায় সংক্ষিপ্ত বার্তা সেবা। মোবাইল থেকে মোবাইলে কোনো বার্তা বা
ম্যাসেজ টাইপ করে পাঠানোর যে সেবাটি এখন বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত, তার নামই
এসএমএস।
গোড়ার কথা
১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম
এসএমএসটি পাঠানো হলেও এর ধারণাটি অনেক আগের। মোবাইল এসএমএস-এর জনক হিসেবে
যাকে অভিহিত করা হয়, তার নাম ম্যাট্রি ম্যাক্কোনেন। ফিনল্যান্ডের এই
প্রকৌশলী নকিয়া, টেলি ফিনল্যান্ড, ফিনেট নামে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ
করেছেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন ফিনল্যান্ডের
টেলিকম ও পোস্টাল এজেন্সিতে এবং ওই সময়েই এসএমএস সার্ভিস নিয়ে গবেষণা শুরু
করেন। ১৯৮৮ সালে ইউরোপিয়ান টেলিকমিউনিকেশন স্ট্যান্ডার্ড ইনিশিয়েটিভ
প্রথম ডিজিটাল প্যান-ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড জিএসএম বাজারে নিয়ে এলে
এসএমএস নিয়ে জোর গতিতে কাজ শুরু হয়। তখন পর্যন্ত ভয়েসমেইল সম্পর্কে জানতে
হলে ভয়েস-মেইল সেন্টারে ফোন দিতে হতো গ্রাহককে। ভয়েস মেইল আসা মাত্রই যেন
গ্রাহকরা জানতে পারে, সেই তথ্য জানাতেই প্রথম এসএমএস পাঠানোর চিন্তা শুরু
হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম টেক্সট ম্যাসেজটি
প্রেরণ করেন নেইল পাপওয়ার্থ। ভোডাফোন তখন তাদের গ্রাহকদের জন্য এই
সার্ভিসটি চালু করতে চাচ্ছিল। তারই পরীক্ষামূলক প্রস্তুতি হিসেবে পাঠানো
এই ম্যাসেজে লেখা ছিল 'Merry Christmas'। পাপওয়ার্থ ম্যাসেজটি পাঠান
ভোডাফোনেরই রিচার্ড জারভিসের কাছে।
শুরুতে জনপ্রিয়তা পায়নি এসএমএস
এসএমএস
সার্ভিসটি সময়ের সাথে সাথে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শুরুতে এটি তেমন
একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৯৪ সাল থেকেই এই সেবা সব টেলিকম অপারেটর চালু করে।
তারপরেও ১৯৯৫ সালেও একজন মোবাইল ব্যবহারকারী মাসে গড়ে এসএমএস পাঠাতেন
০.৪টি। তার মানে গড়ে আড়াই মাস পর পর পাঠানো হতো এক একটি এসএমএস।
পরবর্তীতে টেলিকম কোম্পানিগুলো প্রি-পেইড সার্ভিস বাজারে ছাড়া শুরু করলে
এবং এর জন্য 'রিয়েল-টাইম চার্জিং' শুরু করলে তা ক্রমেই ছড়িয়ে সকলের মাঝে।
১৯৯৪ সালে নকিয়া বাজারে নিয়ে আসে 'নকিয়া ২০১০' মডেলের হ্যান্ডসেট। এটিই
মূলত সহজে এসএমএস লেখার জন্য তৈরি করা প্রথম মোবাইল ফোন। এভাবে ক্রমেই
জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে এসএমএস।
ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে
১৯৯৮
সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রি-পেইড মোবাইল সংযোগ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল
মাত্র ৪৫ হাজার। তবে এর সংখ্যা বাড়তে থাকে দ্রুত। বিশ্বব্যাপীও বাড়তে থাকে
এসএমএস সেবার কার্যক্রম। এসএমএস এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় এসএমএস-এ বাড়তি
ফিচার যুক্ত করা নিয়েও গবেষণা চলতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে টি৯ (T9) প্রথম
প্রেডিক্টিভ টেক্সট লেখার ফিচার চালু করে। অর্থাত্ এ কোনো শব্দ লেখা শুরু
করলেই শব্দগুলো পূর্বানুমাণ করে সাজেশন আসার সুবিধাটি তখন চালু হয়। ২০০০
সালের হিসেবে দেখা যায়, ওই বছর বিশ্ববাপী ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি
এসএমএস পাঠানো হয়। এই সংখ্যাও বছরের সাথে বাড়তেই থাকে। ২০০২ এবং ২০০৪
সালের হিসেবে বিশ্বব্যাপী এসএমএস আদান-প্রদানের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৫২
বিলিয়ন এবং ৯১৮ বিলিয়ন। ২০০৭-এ এই পরিমাণ ছিল ৪.৮ ট্রিলিয়ন। ২০০১১ সালে
দেখা যায় সারা বিশ্বে মানুষ ১০ ট্রিলিয়নেরও বেশি এসএমএস আদান-প্রদান করেছে!
এসএমএস এবং তারুণ্য
বলা
যেতে পারে তরুণদের হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছে এসএমএস সার্ভিস।
২০০০-২০০২ সময়কালে বিশ্বব্যাপী মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে তরুণ অংশটিই
এসএমএসকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এখনকার হিসেবেও দেখা যায় তরুণদের মধ্যেই
এসএমএস করার প্রবণতাটি বেশি। এসএমএস-এর জনপ্রিয়তার সাথে সাথে তরুণদের
নানাভাবেই বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ভাষাগত
পরিবর্তন। এসএমএস-এ অক্ষর লেখার পরিমাণটি সীমিত থাকায় খুব অল্প লিখেই অনেক
কিছু বুঝানোর একটি প্রবণতা তৈরি হয় সেই থেকেই সংক্ষেপে শব্দ লেখার অভ্যাস
গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী। বর্তমানে ফেসবুক, টুইটারে OMG, LOL, bf, gf প্রভৃতি
যে নতুন ধরনের ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, এর সূচনা এসএমএস-এর হাত ধরেই।
হারিয়ে যাবে এসএমএস
সমায়ের সাথে সাথে মোবাইলেও ইন্টারনেট
সহজলভ্য হয়ে ওঠায় অনেকেই এসএমএস-যুগের অবসান দেখতে শুরু করেছেন। স্কাইপি
ইন্সট্যান্ট ম্যাসেজিং এখন এসএমএসকে কিছুটা প্রাচীন প্রযুক্তিতে পরিণত
করেছে বটে, তবে সার্বিকভাবে এখনও তা এসএমএস-এর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে
পারেনি। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়া এশিয়া-আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে
এখনো মোবাইল ইন্টারনেট খরচের দিক থেকে সকলের নাগালের মধ্যে আসতে পারেনি।
আর এ ছাড়াও টিনএজারদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত এসএমএস করার পরিমাণ অনেক বেশি।
সব মিলিয়ে এসএমএস আরও অনেকদিন টিকে থাকবে বলেই আশাবাদী প্রযুক্তি
বিশ্লেষকরা।
এসএমএস সম্পর্কে ম্যাট্রি ম্যাক্কোনেন
এসএমএস-এর
জনক তাকে বলা হয়। তবে তিনি সাধারণত কোথাও সাক্ষাত্কার প্রদান করেন না।
তবে এসএমএস-এর ২০ বছর উপলক্ষে বিবিসিকে তিনি এক অভিনব সাক্ষাত্কার দিয়েছেন
এসএমএস-এর মাধ্যমেই। যেখানে তিনি বলেন, 'আমি নিজেকে এর উদ্ভাবক বলে মনে করি
না। অনেকের প্রচেষ্টাতেই এই প্রযুক্তি আলোর মুখ দেখে।' ২০ বছর ধরে এসএমএস
ক্রমেই জনপ্রিয়তার সূচক বাড়তে থাকায় আরও অনেক দিন এটি রাজত্ব ধরে রাখবে
বলেই আশাবাদ জানান তিনি। এসএমএস-এর মাধ্যমে তরুণরা যে নতুন ধরনের ভাষাগত
পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তা নিয়েও তিনি মোটেও চিন্তিত নন। বর্তমানে তিনি
এসএমএস-এর মতো আরও কোনো উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি
বলেন, 'যদি এমন কোনো প্রযুক্তি আসে, যেটি আমার চশমার কাঁচকে মোবাইলের
ডিসপ্লেতে পরিণত করবে, তাহলে আমি খুশিই হবো। তবে তা নিয়ে কাজ করার অনেক
মানুষই আছে।'
0 comments